২০১৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর Travelers of Greater Sylhet (TOGS) গ্রুপের সাথে করে এলাম আমার জীবনের প্রথম পাহাড় ট্রেকিং। দুর্দান্ত
ট্রেকারদের নিয়ে এটা ছিলো আমার জীবনের সেরা ভ্রমণ গুলোর একটি। আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করবো আমার সেই দুর্গম পাহাড়ী পথে রোমাঞ্চকর অভিযানের গল্প।
ভ্রমণের দিন খুব সকাল বেলা গ্রুপের সবাই একত্রিত হলাম সিলেটের জিন্দাবাজারের পানশী রেস্টুরেন্টে। আমি ছিলাম ঐ দিনের ফার্স্ট বয়। কারণ সবার আগে আমিই হাজির হয়েছিলাম। কর্মস্থলে আমি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সময়মতো উপস্থিত হতে পারি না! কিন্তু কোথাও ভ্রমণে বের হলে সময়ের এদিক সেদিক হয় না।
পানশী রেস্টুরেন্টে ভূনা খিচুড়ি দিয়ে সকালের নাশতা সেরে বের হওয়ার সময় গ্রুপের পক্ষ থেকে সবাইকে TOGS এর লগো সম্বলিত একটা করে গ্রে কালারের টিশার্ট দেওয়া হলো। আমরা সেই টিশার্ট পরে রিজার্ভ বাসে উঠলাম। বাসে অনেক হই হুল্লোড়, আনন্দ উল্লাস হলো। দেড় দু ঘন্টা বাস যাত্রার পরে আমরা পৌছালাম শ্রীমঙ্গল শহরে।
![]() |
এখান থেকে শুরু হয় আমাদের ট্রেকিং |
পাহাড়ে চড়ার ট্রেইলে প্রবেশের পূর্বে সবাই ওখানকার ছোট ছোট শিশুদের
কাছ থেকে ৫ টাকা দিয়ে একটা লাঠি কিনলাম। যেটা পাহাড়ে চড়ার সময় খুব কাজে লাগবে। এরপর
স্থানীয় একজন গাইড নিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম পাহাড়ী দুর্গম রাস্তায়। কখনো খাড়া পাহাড়
বেয়ে উপরে উঠলাম। আবার কখনো ঢালু যায়গায় লাঠিতে ভর দিয়ে নিচে নামলাম। আমি আগে
কল্পনা করিনি যে এতটা কঠিন হবে এই ট্রেকিং ট্রেইল। ঘন্টা খানেক হাঁটার পর যখন
একেবারে মাঝামাঝি যায়গায় এসে পৌছলাম তখন মনে হচ্ছিলো এই টু্যরে এসে আমি ভুল করে
ফেলেছি। এমন একটা যায়গায় এসেছি এখান থেকে সামনে যাওয়াও অসম্ভব মনে হচ্ছে। আবার পেছনে
যাওয়াও অসম্ভব মনে হচ্ছে। আমার মাথায় যখন এরকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে এর কিছুক্ষণ
পরই আমাদের সাথের একজন ভাই হাঁটার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যায়! যার
কারণে এখানে সবাই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেই। ঐ ভাইয়ের জ্ঞান ফিরে আসার পর তাকে এই
জায়াগায় বিশ্রামে রেখে আমরা আবার রওনা দেই ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। কথা ছিলো আমরা ফিরে
আসার আগ পর্যন্ত সে এখানেই থাকবে।
![]() |
ট্রেকিংয়ের মাঝপথে সবাই বিশ্রাম নিচ্ছিলাম |
কয়েকবার মনে হচ্ছিলো আমি শেষ পর্যন্ত যেতে পারবো না। কিন্তু হাম হাম ঝর্ণা দেখার অদম্য ইচ্ছা আর সাথের ভাইদের উৎসাহ আমাকে শেষ পর্যন্ত যেতে সাহায্য করেছে। হাঁটতে কষ্ট হলেও চারিদিকে নিবিড় জঙ্গলে ঘেরা পরিবেশ আমাকে বার বার মুগ্ধ করছিলো। যখন পাহাড়ী ট্রেইলের প্রায় শেষ দিকে এসে হঠাৎ দেখি আমরা যে ভাইকে বিশ্রামে রেখে এসেছিলাম সে আগের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে হেঁটে আমাদের কাছে চলে এসেছে! ঝর্ণা দেখার নেশা তাকে ওখানে আটকে রাখতে পারেনি। ভাইটিকে দেখে আমরা সবাই খুব আনন্দিত হলাম। ঝর্ণার কাছাকাছি আসার পর পাহাড়ী রাস্তা শেষ। শুরু হলো ঝিরি পথ দিয়ে যাত্রা। কখনো হাঁটু পানি, কখনো কোমর পানি অতিক্রম করে যেতে হয়েছে। পকেটের মানিব্যাগ ও মোবাইল হাতে নিয়ে হাত উঁচু করে সেই ঝিরি পথ পাড়ি দিলাম।
![]() |
হাম হাম ঝর্ণার সামনে পুরো দল |
![]() |
হাম হাম ঝর্ণার সামনে আমি |
কঠিন কিন্তু রোমাঞ্চকর একটা ট্রেকিং শেষে যখন ঝর্ণার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম সব কষ্ট মুছে গেলো। ঝর্ণার ঠিক নিচের পানিতে নেমে আনন্দ উচ্ছাস নিয়ে অনেকটা সময় কাটালাম। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করলাম হৃদয় দিয়ে।
![]() |
ফিরে আসার সময় ঝিরি পথে আমি |
শেষ বিকেলে হাম হাম ঝর্ণাকে বিদায় দিয়ে আমরা আবার সেই ঝিরি পথ দিয়ে ফিরতি যাত্রা শুরু করে পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে বের হয়ে
আসলাম ট্রেইল থেকে। তারপর জীবনের প্রথম বার বাধ্য হয়ে একটা ছড়ার ঘোলা পানিতে গোছল
করলাম! অন্য সময় হলে এটা কখনোই করতাম না। গোছল করার আগে যখন পা থেকে জুতা খুললাম
দেখি একটা জোঁক আমার পায়ে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। অনেক রক্ত ঝরেছে। ট্রেকিংয়ের সময়
পায়ে বার বার চুলকাচ্ছিলো কিন্তু এটা বুঝতে পারিনি যে জোঁকে কামড়েছে। ওখানে বেড়ার
ঘরের রেস্টুরেন্টে আগে থেকে অর্ডার করে রাখা হাঁসের মাংস দিয়ে মজাদার একটা খাবার পর্ব
সেরে উঠে পড়লাম আমাদের জীপে। শেষ হলো অসাধারণ একটা ট্রেকিং ট্যুর। ট্রেকিংয়ের সময় বার
বার মনে হচ্ছিলো এরকম ট্যুরে আর কখনো যাব না! কিন্তু ফিরে আসার পর অনুভব করলাম এই
সময়টা কত রোমাঞ্চকর ছিলো।
হাম হাম ভ্রমণ থেকে আসার পরের দিন আমার ফেসবুক পোস্ট: হামহাম ট্যুর ২০১৮।